’যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হলো তার সাধ’
রাজীব মীর:
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট ছিলো না। সাংবাদিকতার বিদেশী পুরনো বই পড়ানো হতো । আপডেট কোনও তথ্য পেতে স্যারদের হাতে কোনও বিদেশী ম্যাগাজিনের ফটোকপি নিয়ে আগ্রহ মেটাতাম । যদিও বন্ধু সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী নিজের বাসায় বসে নেট থেকে সকল নতুন বই – তথ্য যোগাড় করে পরীক্ষা মাত করতো । দেখেছি আর হিংসে করেছি , ঐটুকুই । আফসোস ছিলো যে আমার ঐ সহজলভ্য ইন্টারনেট প্রবেশযোগ্যতা থাকলে আমি হয়ত আরও ভালো করতাম ।
দিন বদলেছে । কয়েক বছরের মধ্যে হু হু করে নেট ছড়ালো দেশে । সাইবার ক্যাফে বসলো, শেষও হলো । এখন তো এন্ডরয়েড, স্মার্টফোন অনেকেরই হাতে হাতে । যে যার মত তথ্য উপাত্ত দিচ্ছে- নিচ্ছে , আ্যাপস বানাচ্ছে , আউটসোর্সিং করছে । ইমো , ভাইভার , হোয়াটস এ্যাপ চোখ লাগিয়ে দিচ্ছে । পোস্ট অফিস কিছুদিন পর যাদুঘর হবে সেই আশংকাও করছেন অনেকেই ।
কিন্তু এতকিছুর পরও বাংলা সিনেমার রূপবতি নায়িকার ‘শরীর পাবি শয়তান কিন্তু মন পাবি না’ ডায়লগের মতোই আমাদের অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে । ফোর- জি জেনারেশন মাদকাসক্তির মতই নেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে । অবসাদ, ক্লান্তি তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব, চক্রের মতো বেড়ে লাভের চেয়ে লোভ বেশি জায়গা করে নিয়েছে। অজানা শত্রু লোভ চরিতার্থ করছে , নেটে বিছানার ছবি ছেড়ে দিয়ে নারীদের জীবন নিয়ে খেলছে অপরিনামদর্শী হঠকারি প্রেমিকের দল । সামাজিক অনিরাপত্তা চরমভাবে বেড়ে গেছে অসামাজিক এ নিয়ত সৃজনশীল মাধ্যমের বদৌলতে । আইন হয়েছে , হচ্ছে কিন্তু থামছে না কিছুতেই ।
আগাছার মতো বিস্তৃত অনলাইন সংবাদপত্রসমূহ বুঝে- না বুঝে , ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক ভালো মানুষের জীবন নরক বানিয়ে ছাড়ছে । ব্যবসা , রাজনীতি আর সস্তা লাভালাভের হিসেব কষে অন্যের জীবন শেষ হওয়া নিয়ে এরা মোটেও ভাবিত নয়। কাট কপি পেস্ট করে সস্তা জনপ্রিয়তা বা উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রকাশ এবং সেক্স , ভায়োলেন্স মসলা মেরে সংবাদ প্রকাশ করে হঠাৎ বাজার দখলের এখনকার ঝোঁক যেন কমছেই না । যদিও যে বিষয়ের অবতারণা করে এ লেখাটা লিখছি , তার প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট আরও গভীর ও বেদনাদায়ক ।
এতক্ষণ যা বললাম , সেই সব কিছুর ভালো মন্দ বা প্রচার প্রসার এর দায়ভার অন্যের হাতে। যদি আপনি নিজেই নিজের মরণ ডেকে আনেন বা নিজেই নিজেকে হত্যা করেন – বিষয়টা অভাবনীয়। কিন্তু সত্য । এখন এমন এক ভিডিও গেমস চালু হয়েছে যা পর্ণাসক্তি বা মাদকাসক্তির চেয়েও ভয়াবহ এবং আমাদের কিশোর-কিশোরীরা সেখানে দারুনভাবে আসক্ত।
ভিডিও গেমস ‘ব্লু হোয়ায়েলস’ এর মত খেলার বলি হয়ে আজই জীবন খুইয়েছেন ঢাকার হলিক্রস স্কুলের এক শিক্ষার্থী , সংবাদ প্রকাশ হয়েছে ।
এ বিপজ্জনক খেলায় ৫০ টি ধাপ আছে । ২৭ তম ধাপে আপনাকে নির্দেশ দেয়া হবে নিজের হাত ব্লেডে কেটে নীল তিমি আঁকতে এবং আপনি আঁকতে বাধ্য । এখানে টার্গেট আছে , আপনাকে সেটা পূরণ করতেই হবে এবং এটা স্বয়ংক্রিয়। কারণ আপনার মধ্যে জেদ চেপে যাবে । এটি এমন একটি গেমস এর সফ্টওয়ার যা রাশিয়ার একজন সফ্টওয়ার বিজ্ঞানী তৈরি করেছেন । এশিয়ায় এটি বেশ জনপ্রিয় খেলা । খেলার ৫০ তম ধাপ হলো অদ্ভুত এক চ্যালেঞ্জ যেখানে আপনাকে আত্মহত্যা করতে চ্যালেঞ্জ জানানো হবে এবং আপনি তাই করবেন ।কিউরেটর আপনাকে সেই ঘুরপাকে ফেলবে এবং নির্দেশ দেবে ।আরও আশ্চর্য হলো এই খেলায় ঢোকা যাবে কিন্তু বের হওয়া যাবে না । আপনি সেটা চাইলেও পারবেন না। এই না পারার কারণ জানতে এখন আপনার মন উশখুশ করছে , জানি । এখান থেকেই হয় শুরু। কৌতূহল আর থামে না, যার পরিণাম স্বেচ্ছা- মৃত্যু ।রাশিয়ায় ১৮১ জন , ভারতে ১৩০ জন এ খেলার জঘন্য পরিণাম নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে ওপারে পাড়ি দিয়েছে ।
এ গেমসের প্রভাবে বাংলাদেশে ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করার কথা শিকার করেছে অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার পরিবার । স্বর্ণা হলিক্রসে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে । ক্লাশে ধারাবাহিকভাবে প্রথমও হয় । কিন্তু তার সকল মেধা আর পরিশ্রম আজ জলে । এক ভয়ংকর খেলার নেশায় আসক্ত হয়ে সে ঝুলে পড়েছে ফ্যানে , কতটা অচিন্তনীয় । হরর ফিল্মের চাঞ্চল্য হার মেনে যাচ্ছে । এরকম ব্লু হোয়ালস নামক খেলার উদ্ভাবনকারীকে সািইকিস্ট সফ্টওয়ার নির্মাতা বলেই অনেক মনে করেন। সিক না হলে এ খেলা তৈরি ও তা বাজারে ছেড়ে দেয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
কিন্তু যেটা সম্ভব তা হলো আমাদের বাচ্চাদের দিকে নজর রাখা , তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া । কারণ বন্ধুহীনতা আর অবসাদগ্রস্থতার কারণে এসব জীবননাশী খেলায় আসক্ত হচ্ছে আজকোলের ছেলে মেয়েরা ।তাদের বন্ধুদের সাথে মিশতে বলুন , আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় করুন । একা থাকতে নিরূৎসাহিত করুন । সবকিছুর প্রতি চোখ রাখুন ।
প্রিয় অপূর্বা , কেন এমন করলে-বোন ! বাবা মায়ের কথা একবারও ভাবলে না ।
যদিও সুইসাইড নোটে তুমি মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করোনি কিন্তু তোমার মৃত্যুর জন্য উদাসিন সমাজ ও ভার্চুয়াল সভ্যতার অবসাদ ও বিষাদ সমানভাবে দায়ী বলেই আমি মনে করি ।
বাংলাদেশের সকল অপূর্ব- অপূর্বারা ব্লু হোয়ালস এর কনভিন্সিং আত্মহনন থেকে মুক্তি পাক,
এটাই প্রত্যাশা।
রাজীব মীর
লেখক ও শিক্ষক